ডায়াবেটিস জিনগত হলেও টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। অজান্তেই ডায়াবেটিস কোপ ফেলে আমাদের কিডনি, হার্ট, চোখ, লিভারের মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে। যে কারণে পরবর্তীতে কোনও শারীরিক জটিলতা হলে এবং অবস্থা কঠিন হলে মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওয়ের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও ডায়াবেটিস থাকলে কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। যে কারণে এই সমস্যায় সবদিক থেকে নিজেকে সাবধানে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।যখন কারও ডায়াবেটিস হয়, তখন ওই মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এতে করে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে থাকে।নিউ ইয়র্কের ওয়েল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের একটি গবেষণা বলছে, সঠিক খাবার খাওয়ার পাশাপাশি কোন ক্রমে সেই খাবার খাওয়া হচ্ছে তার উপরেও রক্তের শর্করার পরিমাণ অনেকটা নির্ভর করে। গবেষকদের দাবি, কার্বোহাইড্রেট প্রথমে খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ যতটা বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় আগে শাক-সব্জি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে অনেকটাই কম থাকে রক্তে শর্করার মাত্রা। আগে প্রোটিন ও শাক-সব্জি খেলে আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও দু'ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে যথাক্রমে ২৯, ৩৭ ও ১৭ শতাংশ।শুধু শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণই নয়, কোন ক্রমে খাবার খাচ্ছেন তার প্রভাব পড়ে বার্ধক্যজনিত লক্ষণ, দেহের ওজন এবং হরমোনের ভারসাম্যের উপরেও। গবেষকদের দাবি, প্রোটিন এবং শাক-সব্জি আগে খেলে শর্করা জাতীয় খাদ্যের আগেই শরীরে পৌঁছে যায় ফাইবার। যার ফলে পরিপাকের গতি ধীর কিন্তু স্থির হয় এবং আচমকা দেহের শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এই পদ্ধতিতে খাবার খেলে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য যেমন বজায় থাকে, তেমনই কমে প্রদাহ, ভাল থাকে ত্বকও। ফলে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে কম।প্রতিদিনের অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড, চিনি, কার্বোহাইড্রেট খাওয়া- এইসবই কিন্তু বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা। যে কারণে ডায়াবেটিসের সমস্যায় আগেই যেমন রাশ টানতে হবে জীবনযাত্রায় তেমনই খাদ্যাভ্যাসেও আনতে হবে পরিবর্তন। ডায়েটে এমন কিছু খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যা রক্তে শর্করার বর্ধিত স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করবে। জেনে নিন যেসব খাবার খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে-
আরো পড়ুন: সকল স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্যকর খাবারগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করে বিস্তারিত দেখুন।
চর্বিযুক্ত মাছ
চর্বিযুক্ত মাছের তালিকায় রয়েছে স্যালমন, সার্ডিন, হেরিং ইত্যাদি মাছ। যে সব মাছ ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড পূর্ণ, যে সব মাছ ডিএইচএ এবং ইপিএ-এর বড় উৎস সে সব মাছই পারে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এছাড়াও নিয়মিত এই সব মাছ খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কিন্তু কমে যায় অনেকটাই। এছাড়াও এই সব খাবারে থাকে ওমেগা-৩ব ফ্যাটি অ্যাসিড। যা আমাদের শরীরের জন্য কিন্তু খুবই ভাল।
শাকসবজি
নিয়মকরে প্রতিদিন সবজি খাবেন। প্রয়োজনে মাছ-মংসের পরিবর্তে সম পরিমাণ সবজি খান। এতেও কিন্তু শরীর থাকবে সুস্থ আর ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ভিটামিন সি
শাক-সবজি খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন নিয়ম করে ভিটামিন সি আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এতে হার্ট, চোখ সবই কিন্তু ভাল থাকবে।
ডিম
শরীরে রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু ভূমিকা রয়েছে ডিমেরও। আর তাই প্রতিদিন একটা করে ডিম খাবেন। এক্ষেত্রে সিম সিদ্ধ খাওয়াই কিন্তু সবথেকে ভাল। হার্টের রোগীরাও নির্ভয়ে খেতে পারেন ডিম।
ডুমুর
পুষ্টিবিদের মতে, ডায়াবেটিসের রোগীদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে ডুমুর। ডুমুরের মধ্যে ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ রিসার্চ ইন ফার্মেসি অ্যান্ড বায়োসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় অনুযায়ী, ডুমুরে হাইপোগ্লাইসেমিক উপাদান রয়েছে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন যে ডুমুর পাতা ইনসুলিন প্রতিরোধের উন্নতিতেও উপকারী।
মটরশুঁটি
মটরশুঁটির গ্লাইসেমির ইনডেক্স খুবই কম। সেই সঙ্গে পুষ্টিতে ভরপুর। যে কারণে ডায়াবিটিসের রোগীদের জন্য কিন্তু খুব ভাল মটরশুঁটি। এছাড়াও খেতে পারেন ব্রকোলি। এতে কার্বোহাইড্রেট একেবারেই নেই, বরং পুষ্টি আছে অনেক বেশি পরিমাণে। যা বিভিন্ন রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে।
টকদই
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ওজন কমাতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে জুড়ি মেলা ভার টকদইয়ের। নিয়মিত ভাবে খেতে পারলে অনেক রকম উপকার পাবে।
চিয়া সিডস
চিয়া সিডসের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার। যা আমাদের রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়াও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকরী চিয়া সিডস। নিয়মিত খেতে পারলে অনেক রকম উপকার পাবনে।
ফ্ল্যাক্সসিডস
ফ্ল্যাক্সসিডস বা তিসিবীজও কিন্তু শরীরের জন্য বেশ ভাল। নিয়মিত খেতে পারলে সুগার, প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। কোলেস্টেরলের সমস্যাতেও কিন্তু তা বেশ ভাল কাজ করে। ইনসুলিনের ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণেও কিন্তু ভূমিকা রয়েছে এই ফ্ল্যাক্সসিডের।
করলা
ডায়াবেটিস কমাতে করলা একটি ভাল ঘরোয়া উপায়। করলা ইনসুলিন-পলিপেপটাইড-পি সমৃদ্ধ, এটি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে। করলাতে ক্যারোটিন এবং মমর্ডিসিন নামক দুটি প্রয়োজনীয় যৌগ থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যৌগিক। ডায়াবেটিস কমাতে সপ্তাহে একবার করলা তরকারি হিসাবে ব্যবহার করুন। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এই রস একটি ছোট গ্লাস পান করুন। এটির সাহায্যে আপনি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন।
আমের পাতা
আমের পাতা আপনাকে দেহে ডায়াবেটিসের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে। রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সূক্ষ্ম ও কোমল আমের পাতাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসার জন্য তাজা আমের পাতা কার্যকর ঘরোয়া উপায়। আমের পাতায় ভিটামিন সি, এ এবং ট্যানিন থাকে যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক চিকিৎসায় সহায়তা করে। ডায়াবেটিস কমাতে আমের পাতাগুলো ধুয়ে শুকিয়ে গুঁড়া করে নিন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে এই গুঁড়া পানি দিয়ে পান করুন। এক গ্লাস পানিতে কিছু তাজা আমের পাতা সিদ্ধ করে সারা রাত ঠান্ডা হতে দিন। সকালে খালি পেটে এর পানি পান করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মেথি
মেথি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, গ্লুকোজ সহনশীলতা উন্নত করতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে কারণ এতে ফাইবার বেশি থাকে। মেথি খেলে হজম শক্তি হ্রাস হয়, যাতে রক্তে সুগার সঠিকভাবে শুষে যায়। এটি টাইপ -১ এবং টাইপ -২ ডায়াবেটিস উভয়ই নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। ডায়াবেটিস হ্রাস করার ঘরোয়া উপায় হিসাবে ২ চা চামচ মেথি বীজ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি বীজ দিয়ে সেই পানি পান করুন। এ ছাড়া প্রতিদিন মেথি বীজের গুঁড়া গরম বা ঠান্ডা পানি বা দুধের সাথে খান।
0 মন্তব্যসমূহ