হেডেক অর্থাৎ মাথাব্যথা মানে শুধুমাত্র মাইগ্রেন নয়। মাথাব্যথার প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা বিষয় অনুসারে মাথাব্যথার নামকরণ করা হয়ে থাকে। কেন মাথাব্যথা হচ্ছে তার কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলে এ ব্যথা উপশমের সর্ব্বোচ্চ চিকিৎসা সম্ভব হতে পারে। ডাক্তার হিসেবে টোমাস ভাইস প্রতিদিন রোগী দেখা শুরু করার আগে সচেতনভাবে শাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অতীতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে আমার অনেক সমস্যা হয়েছে৷ আমি ভাবতাম, বিষয়টি রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক৷ কিন্তু আচমকা বিষয়টি নিয়ে গভীর চর্চা করে বুঝলাম, যে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের এই দিকটা, অর্থাৎ আমাদের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন আমাদের শরীরের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে৷’’স্ট্রেস মস্তিষ্কের অত্যন্ত পুরানো এমন এক কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলে, যা আমাদের লড়াই অথবা পালানোর জন্য প্রস্তুত করে৷ ক্রমাগত চাপের মুখে পড়লে শরীর শ্বাস-প্রশ্বাসে রদবদল করে প্রতিক্রিয়া দেখায়৷ দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় চোখেই পড়ে না৷ সেই অবস্থাকে ক্রনিক হাইপারভেন্টিলেশন বলা হয়৷ প্রায় অবচেতনে সেই প্রক্রিয়া স্বংয়ক্রিয়ভাবে ঘটে৷এমন সব সংযোগের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি৷ তা সত্ত্বেও টোমাস ভাইস নিশ্চিত, যে নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক সমস্যা ভুল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ যেমন স্টেফানি কেক নামের এক রোগী মাথা ঘোরার সমস্যায় ভুগছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার আসলে কী হয়েছে, তা কেউ জানতে পারে নি৷ ভেবেছিল সাইকোসোমেটিক্সের সমস্যা৷ কিন্তু তাতে আমার কোনো লাভ হয় নি৷ ড. ভাইসকে খুঁজে পেয়ে আমি সত্যি খুব খুশি৷''রোগ নির্ণয়ের বিস্তারিত প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রোগীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের বিশেষ ট্রেনিং পান৷ তথাকথিত ক্যাপনোমিটার দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে সচেতনভাবে তারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ ড. ভাইস বলেন, ‘‘শরীরে ভেজিটেটিভ স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে এমন এক ভাষার প্রয়োজন, যা শরীরের খুব নিবিড়ে থাকবে, এমনকি প্রাণীরাও তা বুঝতে পারবে৷ সে কারণে আমরা মাসাজ, উত্তাপ, খাদ্য ও পানীয় নিয়ে কাজ করি৷ এভাবে অবচেতন এই স্নায়ুতন্ত্রকে বুঝিয়ে দেই, আতঙ্কের কোনো কারণ নেই, সব ঠিক আছে৷''সিওটু মাত্রা বাড়াতে রোগীরা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের যাবতীয় গুরুত্ব শেখেন৷ ড. টোমাস ভাইস বলেন, ‘‘নাকের মধ্য দিয়ে অনেক কম বাতাস যায়৷ সে কারণে মানুষ হিসেবে আমরা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস না নেবার চেষ্টা করি৷''রোগীরা যাতে শারীরিক কসরতের ক্ষেত্রে মুখের বদলে শুধু নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেন, সেই লক্ষ্যে বিশেষ ট্রেডমিলের উপর তাদের অনুশীলন করতে হয়৷ ভ্যাকুয়ামের এক বস্তা তাদের শরীরের ওজন ধরে রাখে৷ মাধ্যাকর্ষণ ও গতি ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ যতটা সম্ভব নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার সীমা কিন্তু অতিক্রম করা হয় না৷টোমাস ভাইস তাঁর কাজের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর৷ এখনো পর্যন্ত শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে খুব কম গবেষণা হয়েছে৷ তিনি এখনো পর্যন্ত তাঁর ব্রিদিং ও রিল্যাক্সিং থেরাপির মাধ্যমে প্রায় ১০,০০০ রোগীকে সাহায্য করতে পেরেছেন৷ অবশ্যই শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সব রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়৷ ড.ভাইস বলেন, ‘‘কোনো টিউমার, পা ভাঙা বা ফুসফুসের প্রদাহের ক্ষেত্রে সেটা কাজ করে না৷ তবে কঠিন বিঘ্নের ক্ষেত্রে অবশ্যই কার্যকর হয়৷ মাথাব্যথা, ফাইব্রোমায়ালজিয়া সিন্ড্রোম, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম, মাথাঘোরা এবং দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ার মতো সমস্যার উন্নতির ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্পষ্ট উন্নতি সম্ভব৷ কখনো খুব কম সময়ের মধ্যেই উপকার পাওয়া যায়৷
১. মাথার একপাশে: মাইগ্রেন
যদি মাথাব্যথা আপনার মাথার একপাশে (মাথার বামপাশ অথবা ডানপাশ) অবস্থান করে এবং মাথায় ধকধকানি ও স্পন্দন অনুভূত হয়, তাহলে তা মাইগ্রেনের লক্ষণ হতে পারে। মাইগ্রেনে ভোগার এক ডজনেরও বেশি কারণ রয়েছে, পরিত্রাণ পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টারের স্নায়ুবিশারদ ডা. রাইসা ভিলানুয়েভা বলেন, মাইগ্রেনের ব্যথা তীব্র হয় এবং কার্যক্রমে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি অন্যান্য উপসর্গের মাধ্যমেও প্রকাশ পেতে পারে (যেমন- লাইট অ্যান্ড সাউন্ড সেনসিটিভিটি বা আলো ও শব্দ সংবেদনশীলতা)। যত দ্রুত সম্ভব মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে এবং বিশ্রাম নিতে রাইসা ভিলানুয়েভা উপদেশ দেন। যদি এ ব্যথা বারবার আপনার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে, তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।'
২. মাথার চারদিক জুড়ে: টেনশন হেডেক
মানসিক চাপ বা বিষণ্নতাজনিত মাথাব্যথাকে টেনশন-টাইপ হেডেক বা দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা বলা হয়। ভিলানুয়েভা বলেন, রোগীরা প্রায়সময় বলেন যে, এ ব্যথায় ভাইস বা আঁটসাট যন্ত্র মাথার চারদিকে চেপে আছে বলে মনে হয়। ওভার দ্য কাউন্টার পেইন রিলিভার, যেমন- এনএসএআইডি বা অ্যাসিটামিনোফেন, সেবনে এ ব্যথা অঙ্কুরে বিনষ্ট হতে পারে। দ্য জার্নাল অব হেডেক অ্যান্ড পেইনে প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যায়, শুধুমাত্র অ্যাসিটামিনোফেন বা প্ল্যাসেবো সেবনের পরিবর্তে অ্যাসপিরিন, অ্যাসিটামিনোফেন এবং ক্যাফেইনের সমাহারে তুলনামূলক দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, এ তিনটি ওষুধ একত্রে গ্রহণে এ ধরনের মাথাব্যথা দুই ঘণ্টা পর সেরে যায়।
৩. মুখমণ্ডলে: সাইনাস হেডেক
যদি আপনি চোখে এবং গালে চাপ অনুভব করেন, তাহলে তা সাইনাস হেডেকের লক্ষণ বলে ধরে নিতে পারেন। ভিলানুয়েভা উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাইনাস হেডেক খুব বিরল এবং প্রায়সময় তা আসলে মাইগ্রেন, যার কারণে মুখমণ্ডলে ব্যথা হতে পারে। আপনার যদি ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন ধরা পড়ে এবং সাইনাস ইনফেকশনের অন্যান্য উপসর্গ, যেমন- দুর্বল বা রুগ্ন দাঁত, ঘ্রাণানুভূতির অভাব, থাকলে আপনার ডাক্তার আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক (ব্যাকটেরিয়াল উপসর্গের ক্ষেত্রে) প্রেসক্রাইব করতে পারেন অথবা ন্যাজাল ডিকনজেস্ট্যান্ট স্প্রে বা অ্যান্টিহিস্টামিন ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন।
৪. হঠাৎ মাথার যেকোনো অংশে: থান্ডারক্ল্যাপ হেডেক
অন্ততপক্ষে ১৬টি লক্ষণ রয়েছে যাতে আপনার মাথাব্যথা অনেক বেশি গুরুতর হতে পারে এবং তাদের মধ্যে থান্ডারক্ল্যাপ হেডেক একটি হতে পারে। থান্ডারক্ল্যাপ হেডেকের ক্ষেত্রে মাথার ভেতর বজ্রাঘাত অনুভূত হয়। আমেরিকান মাইগ্রেন ফাউন্ডেশনের মতে, এ ব্যথা তীব্র হয়, কমপক্ষে পাঁচ মিনিট থাকে এবং আপনি হয়তো জানতেও পারবেন না কেন তা হচ্ছে। মাথাব্যথার প্রকারভেদের মধ্যে এ ধরনের মাথাব্যথা বিপদাশঙ্কার নির্দেশ করতে পারে। আপনার যদি এরকম মাথাব্যথা হয়, তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন অথবা ইমার্জেন্সি রুমে যান। ব্রেইন অ্যানিউরিজম, স্ট্রোক অথবা ব্রেইন হেমোরেজের কারণে এ মাথাব্যথা হতে পারে। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা সেবা নিন।
৫. চোখের পিছনে: ক্লাস্টার হেডেক
যদি আপনি অনুভব করেন যে চোখের পিছন থেকে কোনোকিছু আপনাকে খোঁচা দিচ্ছে, তাহলে তা ক্লাস্টার হেডেকের লক্ষণ হতে পারে। ভিলানুয়েভা বলেন, এই মাথাব্যথাকে সুইসাইড হেডেকও বলে, কারণ এতে ব্যথা খুব খুব তীব্র হয়। তিনি আরো বলেন, এটি প্রায়ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি প্রভাবিত করে এবং এর সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ, যেমন- ব্যথার সঙ্গে চোখে লালতা, আক্রান্ত চোখ থেকে পানি পড়া, আক্রান্ত পাশে রানি নোজ অথবা আক্রান্ত চোখের পাতা ঢলে পড়া, জড়িত থাকতে পারে। এটি হলে আপনার মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে এবং আপনি জেগে উঠতে চাইবেন। ভিলানুয়েভা বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি নির্ণীত হওয়ার আগে লোকেরা অনেক বছর ধরে এতে ভুগে থাকে। এই মাথাব্যথার ক্ষেত্রে সঠিক ডায়াগনোসিস খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মাইগ্রেনের চেয়ে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা ভিন্ন। এটি থেকে মুক্তি পেতে আপনার ডাক্তার হাই-ফ্লো অক্সিজেন ট্রিটমেন্টের (ফেইস মাস্ক থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করা) পরামর্শ দিতে পারেন।
0 মন্তব্যসমূহ